আজকের এই ডিজিটাল যুগে গ্রহ-নক্ষত্রের ছবির মানও যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ মহাকাশের কঠিন পরিবেশে অতি উচ্চ মানের ছবি তোলে যে ক্যামেরা, তার বেশ কয়েকটি তৈরি করেছে জার্মানির এক প্রতিষ্ঠান৷
পৃথিবীর ক্যামেরা দিয়ে কি আর মহাকাশে ছবি তোলা চলে? এক বিশেষ ক্যামেরা দিয়ে গবেষকরা আলোর সাতটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ছবি তুলতে পারেন৷ সেই ছবি দিয়ে বহু দূরের জগতে ধাতুর অনুপাতও বিশ্লেষণ করতে পারেন তাঁরা৷
মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা-র ‘ডন' মহাকাশযানে প্রায় ৮ বছর ধরে উড়ে চলেছে এমন একজোড়া ক্যামেরা৷ ‘ভেস্টা' নামের গ্রহাণু ও ‘সেরেস' নামের এক বামন গ্রহ পরীক্ষা করাই তার কাজ৷ এই দীর্ঘ যাত্রাপথে ক্যামেরার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গবেষকদের অনেক ব্যবস্থা করতে হয়েছে৷ এমপিআই-এর প্রধান প্রফেসর উলরিশ ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘‘কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে চালু থাকাই এই ক্যামেরার চ্যালেঞ্জ৷ যেমন অতি নিম্ন বা উচ্চ তাপমাত্রায়৷ মহাজাগতিক রশ্মি সামলাতে হবে৷ ক্যামেরাকে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যও হতে হবে৷ যানটি মাত্র একবার ওড়ার সুযোগ পাচ্ছে, তাই মেরামতির কোনো উপায় নেই৷''
জার্মানির মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের সৌরজগত গবেষণা শাখার বহু দশকের অভিজ্ঞতা এমনস্পেস ক্যামেরা তৈরির ক্ষেত্রে কাজে লেগেছে৷ বায়ুমণ্ডল গবেষণার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ শুরু হয়েছিল৷ ১৯৪৬ সালে গ্যোটিঙেন শহরের কাছে ছোট একটি শহরে সেটি স্থানান্তরিত করা হয়৷ রেডিও বার্তার জন্য গবেষকরা প্রথমে বায়ুমণ্ডলে ইলেকট্রিক চার্জ পরীক্ষা করতেন৷ এরপর নীচের স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার নিয়েও তারা গবেষণা করেন৷ রকেট ও বেলুন পাঠিয়ে প্রথম পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন তাঁরা৷ এমপিআই-এর প্রাক্তন প্রধান পেটার চেকভস্কি বলেন, ‘‘বলতেই হবে, যে আমাদের ভাগ্য সত্যি ভালো ছিল৷ আমরা এতজন যোগ্য কর্মী পেয়েছিলাম৷ তাছাড়া সে সময়ে ক্যামেরার জন্য ডিটেক্টরও ছিল নতুন এক ক্ষেত্র৷ কাজেই অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন ছিল৷''
সাফল্য অবশ্যই এসেছিল৷ মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে৷ইউরোপের প্রথম ইন্টারপ্ল্যানেটারি গবেষণা স্যাটেলাইটে এমপিআই-এর ক্যামেরা স্থান পেয়েছিল৷ ১৯৮৬ সালে প্রথম ধূমকেতু অভিযানের সময় তা থেকে চমকপ্রদ ছবি পাওয়া গিয়েছিল৷
এরপর ২০০৫ সালে ‘হিগেন্স' নামের যান যখন শনিগ্রহের রহস্যজনক চাঁদ টাইটান-এর কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনও মাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউটের ক্যামেরা সেই ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি তুলেছিল৷ সৌরজগতের বহির্সীমায় সেটাই ছিল কোনো যানের প্রথম অবতরণের ঘটনা৷
১৯৯৭ সালে মঙ্গলগ্রহে ‘পাথফাইন্ডার' অভিযানের সময়ে তোলা ছবির জন্য টেলিভিশন পুরস্কারও জুটেছিল৷ এই প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের চাবিকাঠি কী? অধ্যাপক উলরিশ ক্রিস্টেনসেন বলেন, ‘‘আমার ধারণা, এর তিনটি কারণ রয়েছে৷ প্রথমত চাই এমন বিজ্ঞানী, যাঁদের মাথায় চোখ-ধাঁধানো যন্ত্রপাতি তৈরির আইডিয়া রয়েছে৷ তারপর চাই এমন ভালো ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিশিয়ান, যাঁরা এই সব আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে পারেন৷''
সেইসঙ্গে অবশ্যই এমন ওয়ার্কশপও চাই, যেখানে হাইটেক ক্যামেরার যন্ত্রাংশ তৈরি হয়৷ নতুন ইনস্টিটিউটে তার জন্য যথেষ্ট জায়গাও রয়েছে৷ সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যতের প্রকোশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ ভবিষ্যতের গবেষণা অভিযানে এমন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে৷ সেখানে ভবিষ্যতের অপটিকাল যন্ত্রপাতি সৃষ্টি হচ্ছে৷ এক হাইটেক টেলিস্কোপ সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র সম্পর্কে নতুন তথ্য সংগ্রহ করবে৷ এর জন্য প্রয়োজন নিখুঁত পরিমাপ৷ অথচ তার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নেই৷ তাপমাত্রার বিশাল তারতম্য সামলানোও কঠিন কাজ৷ তার উপর রয়েছে সৌর বাতাসের উপদ্রব৷ এমপিআই-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সামি সোলাংকি বলেন, ‘‘এগুলি চার্জড পার্টিকেল – অর্থাৎ বাইরে থেকে বিদ্যুত এসে শর্ট সার্কিট সৃষ্টি করতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে আমাদের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে৷ যেমন সেগুলি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে পার্টিকেল কোনো ক্ষতি করতে না পারে৷''
গবেষকরা ভবিষ্যতেও বড় মহাকাশ সংস্থাগুলির কাছ থেকে অর্ডারের আশা করছেন৷ যেমনটা সৌর টেলিস্কোপের ক্ষেত্রে ঘটেছিল৷ অন্যান্য টিমও প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, তবে বরাত পেয়েছে এমপিআই৷
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন