খাবারের তালিকাভুক্ত ৪৩ ধরনের পণ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে। এসব পণ্যে শতকরা ৪০ ভাগ ভেজালের সন্ধান পেয়েছে জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট (আইপিএইচ)। এর মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ। ভেজাল বা নিুমানের খাদ্য শনাক্ত হলেও এগুলো বিক্রি বন্ধে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে প্রতিদিন ভেজাল খাবারের প্রভাবে দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্তের আশংকা বাড়ছে।
ভোক্তাদের অভিযোগ- ভেজাল মেশানোয় পণ্যের মান কমছে। ছোট হচ্ছে আকার। দামও দিতে হচ্ছে বেশি। এভাবে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ক্রেতা ও ভোক্তা। মুনাফা লুটছে অসাধু ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। আইপিএইচ পরীক্ষা করেছে এমন পণ্যের মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে সয়াবিন তেল। এ তেলে ফ্রি ফ্যাটি এসিডের (ফলিক এসিড) উপাদান পাওয়া গেছে শতকরা দুই দশমিক আট ভাগ। এ তেলে ফলিক এসিডের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে শতকরা দুই ভাগ। ফলিক এসিডসহ অন্য সব মিলে সয়াবিনে ভেজালের মাত্রা দাঁড়িয়েছে শতকরা ৭৮ ভাগ। চালের মধ্যে ভেজালের পরিমাণ শতকরা পাঁচ ভাগ। একইভাবে অন্যান্য পণ্যেও ভেজাল শনাক্ত করেছে আইপিএইচ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ভেজালে অভিযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের নাম এখনও মন্ত্রণালয়ে আসেনি। এ ধরনের পণ্যের তালিকা হাতে পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বিক্রেতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ের স্যানেটারি পরিদর্শকরা ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খাদ্যপণ্যের নমুনা সংগ্রহ করেন। তারা এসব নমুনা জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধীন পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিতে পাঠান। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি ৪৩টি খাদ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ২ হাজার ১৪৭টি নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়াবহ ভেজালের উপস্থিতি ধরা পড়ে। শতকরা হিসাবে এ ভেজালের গড় হার ৪০ ভাগ। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৩টি পণ্যের মধ্যে ১৩টিতে প্রায় শতভাগ ভেজাল পাওয়া গেছে। ভেজালযুক্ত এসব খাদ্যপণ্য হচ্ছে- মধু, মিষ্টি, ঘি, রসগোল্লা, ডালডা, দই, সেমাই ও ছানা, ছানার মিষ্টি, চমচম, চাটনি, বিভিন্ন ধরনের জুস, লজেন্স ইত্যাদি। এর বাইরে প্রায় ৮০ শতাংশ ভেজালের অস্তিত্ব রয়েছে অতি ব্যবহার্য ভোজ্যতেলে। সয়াবিন তেলে ভেজালের হার শতকরা ৭৮ ভাগ, সরিষার তেলে ৫৬ ভাগ, পাম অয়েলে ৩২ ভাগ, নারিকেল তেলে ২৫। বাকি পণ্যগুলোতে ভেজালের মাত্রা হচ্ছে- জিরার গুঁড়ায় ১৮ শতাংশ, মরিচের গুঁড়ায় ৬০ শতাংশ, হলুদ গুঁড়ায় ৩১ শতাংশ এবং ধনিয়ার গুঁড়ায় ৫৩ শতাংশ ভেজাল চিহ্নিত হয়েছে। আটা ও আটাজাত দ্রব্যের মধ্যে আটায় শতকরা ভেজালের পরিমাণ ১১ ভাগ, ময়দায় ৯ ভাগ, সুজিতে ২৭ ভাগ, বিস্কুটে ৪৬ ভাগ, বেসনে ৫২ ভাগ এবং সেমাইয়ে ৮২ ভাগ ভেজালের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মুগ ডালে ভেজালের পরিমাণ নয় ভাগ।
অন্যদিকে চিনিতে ৫ শতাংশ, লবণে ৩৬ শতাংশ, চা পাতায় ১০ শতাংশ, আখের গুড়ে ৫৭ শতাংশ, খেজুরের গুড়ে ২৫ শতাংশ, মুগ ডালে ৯ শতাংশ, চাটনিতে ৮৩ শতাংশ এবং কেকে ৭০ শতাংশ ভেজাল চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্ট্যার্ন্ডাস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সঠিক মানের সয়াবিন তেল নির্ণয় করতে এর রং, এসিড ও আয়োডিন ভ্যালু, রেজিস্ট্রিভ ইনডেন্টিং ও মেল্টিং পয়েন্ট পরীক্ষা করা হয়। যেসব তেল সঠিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরিশোধন করা হয়, সেগুলোয় এসিড ভ্যালু কম থাকে। যেগুলোয় এসিড ভ্যালু বেশি থাকে সেগুলো পরিশোধন ছাড়াই বা স্বল্প পরিশোধনে বাজারজাত করা হয়।
তবে অভিযোগ আছে, দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদক ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অতি মুনাফার লোভে খরচ বাঁচাতে শতভাগ পরিশোধন ছাড়াই বাজারজাত করছে এসব ভোজ্যতেল। এতে কৌশলে কিংবা ম্যানেজ ফর্মুলায় এড়িয়ে যাচ্ছে মান নিয়ন্ত্রণকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নজরদারি। এর ফলে এ ভোজ্যতেল প্রতিনিয়ত জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ভোজ্যতেলই নয়, পরীক্ষায় ধরা পড়া সব ভেজালসামগ্রীই মানবদেহের জন্য মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতির কারণ বলে জানান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভেজাল ও মানহীন খাদ্যদ্রব্য নিয়মিত গ্রহণের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। স্বল্পমেয়াদে বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, খাবারে অরুচি ও হৃৎপিণ্ডে ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, কিডনি ও ফুসফুসও আক্রান্তের আশংকা আছে। এছাড়া উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে যে কোনো মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ আছে। আইন কার্যকরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে এ প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো প্রভাব বাস্তবে দেখা যায় না। ফলে দিন দিন খাদ্যে নকল ও ভেজালের মাত্রা বাড়ছে। আইনের দুর্বলতার কারণে ভোক্তা অধিকার লংঘনের দায়ে সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এ আইনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. এ কে এম জাফর উল্লাহ বলেন, খাদ্যপণ্যে এ ধরনের ভেজালের কারণে মানবদেহে শক্তির জোগান ও টিস্যু গঠন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলিক এসিডের অতিরিক্ত মাত্রা হার্টের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমন কি দেহের বিভিন্নস্থানে ক্যান্সারও হতে পারে।
সম্প্রতি ‘বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতকরণ : গৃহীত কার্যক্রম ও করণীয় শীর্ষক’ এক সেমিনারে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক বলেন, নকল-ভেজাল ও বিষযুক্ত খাদ্য খাইয়ে মানুষকে ধীরে ধীরে মারা ও কাউকে এক খুন করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এরা উভয়ই আইনের চোখে সমান অপরাধী। তাই খাদ্যে ভেজালদাতাদেরও সমানভাবে শাস্তি পেতে হবে। তবে বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করার পাশাশি ভেজালদাতাদের যথা উপযুক্ত শাস্তি দিতে হলে আরও কঠোর আইনের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আর আইন কমিশনের সদস্য ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির ওই অনুষ্ঠানে নিরাপদ খাদ্য আইনের বিচার স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের আওতায় আনার পরামর্শ রাখেন।
এ পরিস্থিতিতে দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশে সব ভোক্তার নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার চলতি বছরের ১ ফেব্র“য়ারি থেকে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন কার্যকর করেছে। ওই আইনে খাদ্যে ভেজালের জন্য পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ এর কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় কাজ শুরু করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আগের খাদ্য অধ্যাদেশে কোনো ব্যক্তি অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদক, প্রক্রিয়াকারী বা বিক্রেতার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করতে পারতেন না। বর্তমান বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে সরাসরি মামলাও করারও সুযোগ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, খাদ্যে নকল ও ভেজালরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, সিটি কর্পোরেশন, র্যাবের টিম যৌথ ও পৃথক অভিযান চালাচ্ছে। একই সঙ্গে খাদ্য বিষমুক্ত করতে সরকার ফরমালিন আইনও প্রণয়ন করে। ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ বিল-২০১৫ নামে এ বিলটি সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে। এতে যাবজ্জীবন বিধান রেখে খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের ব্যবহার রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এর অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ২০ লাখ ও সর্বনিু পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ওই আইন অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফরমালিন আমদানি, উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ, বিক্রয় ও ব্যবহার বা দখলে রাখতে পারবে না। এছাড়া লাইসেন্স, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, হিসাব বই, রেজিস্টার সংরক্ষণ ও মাসিক প্রতিবেদন দাখিল, তদন্ত, পরিদর্শন, ফরমালিন বিক্রয়ের দোকান সাময়িকভাবে বন্ধসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধান করা হয়েছে। তদন্ত, তল্লাশি, আটক, বাজেয়াপ্তকরণ, পরোয়ানা জারির ক্ষমতা, পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, তল্লাশির পদ্ধতি, আটক, আটক ব্যক্তি ও মালামাল বিষয়ে মামলা দায়ের এবং গ্রেফতারের ক্ষমতাসহ অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধানও রয়েছে এ আইনে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সূত্রে জানা গেছে, ভোক্তার সুরক্ষায় তৈরি ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’ও পুরোপুরি ভোক্তাবান্ধব নয়। এ আইনে নানা দুর্বলতা রয়ে গেছে। এ কারণে ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছে না। আবার যে আইনটি তৈরি করা হয়েছে ওই আইনে ভোক্তার সুরক্ষায় কি কি সুবিধা দেয়া হয়েছে, আইন লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, কারা এটি প্রয়োগ করবে কিংবা কোথায় অভিযোগের জন্য যেতে হবে- এসব দিক-নির্দেশনা জানা নেই ভোক্তাদের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে দেশের ভোক্তারা খুবই অসহায়। ভোক্তার এ অসহায়ত্ব ঘোচাতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, আইন এবং শাস্তি আরও ব্যাপক জনমুখী, গণমুখী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা, মাঠপর্যায়ের জরিপ, বাস্তব অবস্থা, ভোক্তার স্বার্থবিনাশী সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ থাকতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভোক্তার স্বার্থরক্ষার গুরু দায়িত্বটি সরকারের হাতে। শুধু নিয়মরক্ষার কাজ করলেই হবে না।
বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউ’র সাবেক উপ-উপাচার্য ও বিএমএ’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, দেশব্যাপী যেভাবে ভেজাল বিস্তার লাভ করেছে এবং জনস্বাস্থ্যের নমুনা পরীক্ষায় যে ফল পাওয়া গেছে তাতে মন্তব্য করার আর কিছু নেই। তিনি বলেন, ভেজালের যে নমুনা দেখা যাচ্ছে তাতে মৃত্যুসহ যে কোনো ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ঘটতে পারে। তিনি বলেন, এভাবে ভেজাল নির্ণয় করে বেশি ফল পাওয়া যাবে না। দেশের মানুষকে নিরাপদ খাবার দিতে হলে অবশ্যই একটি স্বতন্ত্র মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন। যা প্রতিষ্ঠা করা শুধু সরকারের পক্ষেই সম্ভব।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন