Ads (728x90)

একটু স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করলেও মাছদের শ্বাসকার্যের সাথে আমাদের শ্বসনের বিষয়টা মাথায় খটকা লাগিয়ে ফেলে। কারন মাছ এবং মানুষ উভয়েরই শ্বসনের প্রধান উপকরণ হলো অক্সিজেন। কিন্তু মাছ পানির নিচে অনায়াসেই শ্বাসকার্য চালাতে পারলেও মানুষ পারে না। কিছুদিন আগে আমার এক ছাত্র আমাকে প্রশ্নটি করলে তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এ বিষয়ে একটি টিউন করার পরিকল্পনা মাথায় আসে। রসায়নের দৃষ্টিকোন থেকে এবং কিছুটা প্রযুক্তির সংমিশ্রনে আজকের টিউনটি তৈরী করেছি। আজ আমরা জানবো- কেন মাছেরা পানির নিচে শ্বাস নিতে পারলেও আমরা পারি না, মাছদের সাথে আমাদের শ্বসন প্রক্রিয়ার পার্থক্য এবং কীভাবে মাছের মতো পানিতে শ্বাস নেওয়া যায় সেই উপায় সম্পর্কে। তো চলুন শুরু করা যাক।

শ্বসনের জন্য পানি কি সত্যিই উপযোগী?

রাসায়নিক পদার্থের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যখন কিছু মৌল বা যৌগকে উপযুক্ত শর্ত সাপেক্ষে এক সাথে মেশানো হয় তখন তারা পরস্পর মিলিত হয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম বিশিষ্ট পদার্থ সৃষ্টি করে। যার মধ্যে বিক্রিয়ক সমূহের কোন চিহ্ণ দেখা যায় না। বা নতুন উৎপন্ন পদার্থটি তার গাঠনিক উপাদানগুলোর মতো আচরণ করে না। যেমন আমরা যদি কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনকে একটা বিশেষ পদ্ধতিতে একত্র করি তাহলে তারা গ্লুকোজ তৈরী করবে। অন্যান্য পদ্ধতিতে করলে তারা যথাক্রমে ভিনেগার (ইথানোয়িক এসিড), অ্যালকোহল, কিংবা চর্বি তৈরী করতে পারে। এই নতুন তৈরী হওয়া গ্লুকোজ, ভিনেগার, ইথানল এবং ফ্যাট এর সাথে এর গাঠনিক উপাদান অক্সিজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন কোন মিল নেই।
হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন কে যদি আমরা ২:১ (অনুপাত) হিসাবে মিশ্রিত করি তাহলে দুই অনুপাত পানি তৈরী হবে। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি পানির গাঠনিক উপাদান হলো হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন পানি যদি অক্সিজেন দিয়ে তৈরী হয় তাহলে পানিতে কেন আমরা শ্বাস নিতে পারি না? কারন চেয়ার টেবিলকে ভাঙ্গলে এর গাঠনিক উপাদানগুলো (কাঠ) আমরা সহজেই পেয়ে যাই। তাহলে পানি থেকে আমরা কেন অক্সিজেন পাবো না? এই প্রশ্নের উত্তর আমি আগের অংশে ব্যাখ্যা করেছি। মানে হলো পানি তৈরী হওয়ার পরে তার সাথে তার গাঠনিক উপাদানের কোন সম্পর্ক থাকে না। তাই বিশুদ্ধ পানির মধ্যে শ্বসনের উপযোগি কোন অক্সিজেন থাকে না। এই পর্যন্ত কথাগুলো খুশি মনে নিলে মাথায় আরেকটি প্রশ্ন উদয় হবে। সেটা হলো মাছেরা কীভাবে তাহলে পানিতে শ্বাস নেয়? কারন তারাও তো অক্সিজেন নির্ভর!

মাছেরা পানিতে যেভাবে শ্বাস নেয়

আপনাদের অবাক করে দিয়ে একটি তথ্য আপনাদের বলতে চাই, মাছেরা শ্বসনের জন্য যে অক্সিজেন ব্যবহার করে থাকে সেই অক্সিজেন পানি থেকে আসে না। মূলত পানির সাথে অক্সিজেন সহ আরও কিছু গ্যাস দ্রবীভুত অবস্থায় থাকে। যেমনটা কোমল পানিয়ের সাথে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস উচ্চ-চাপে দ্রবীভুত থাকে। পানির সাথে স্বল্প দ্রবনীয় অক্সিজেন গ্যাস মাছেরা তাদের শ্বসনের জন্য সংগ্রহ করে। মূলত বাতাশে যে পরিমাণ অক্সিজেন থাকে তার বিশ ভাগের এক ভাগ অক্সিজেন পানিতে থাকে। কিন্তু পানি অনেক ভারি এবং পুরু বিধায় পানি থেকে এই অক্সিজেন আলাদা করা কষ্টকর।
মাছেরা তাদের ফুলকার সাহায্যে পানি থেকে অক্সিজেন শোষণ করতে পারে। এখন কথা হলো, মাছের জন্য কি এই পরিমাণ অক্সিজেন যথেষ্ট? আমরা জানি, মাছ একটি শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণী। এ কারনে মাছের শ্বসনের জন্য স্বল্প পরিমাণ অক্সিজেনই যথেষ্ট। মাছ তাদের ফুলকার সাহায্যে যে পরিমাণ অক্সিজেন শোষন করে সে পরিমাণ অক্সিজেন তাদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট হলেও মানুষ কি পানিতে শ্বাস নিতে পারবে? যদি পারে তাহলে কীভাবে আর যদি না পারে তাহলে কেন পারবে না?

মানুষ কি পারবে পানিতে শ্বাস নিতে? না পারলে সেটা কেন?

আমরা সকলেই জানি মানুষ পানির নিচে শ্বাস নিতে পারে না। যদি পারতো তাহলে প্রত্যেক বছর অন্তত হাজারখানেক মানুষ পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করতো না। যাহোক, মাছ মুখ ভরে অক্সিজেন যুক্ত পানি শোষন করে আর মাছের ফুলকা সেই পানি থেকে অক্সিজেনকে আলাদা করে ফেলে। মানুষের শ্বসনের জন্য রয়েছে ফুসফুস যেটি মাছের মতো এতো পরিমাণ অক্সিজেন যুক্ত পানি শোষন করতে পারে না। তাছাড়া মানুষের ফুসফুস শুধু বাতাস ধারণের জন্য। এখানে যদি পানি প্রবেশ করে তাহলে মারাত্মক বিপদ হতে পারে।
আমি আগেই বলেছি বাতাসের চাইতে পানিতে বিশ ভাগ অক্সিজেন কম থাকে। তাই সেখান থেকে মানুষ অক্সিজেন সহজেই পৃথক করতে পারে না। কিন্তু যদি এমন কোন তরল পাওয়া যেত যেখানে অধিক পরিমাণে অক্সিজেন দ্রবীভুত করা যায় তাহলে কি হতো? এরকম একটা তরলের সন্ধান বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছে সেখানে অধিক পরিমাণ অক্সিজেন দ্রবীভুত করা যায়। সেই তরলটির নাম ফ্লোরোকার্বন। আমাদের ফুসফুস ফ্লোরোকার্বন থেকে সফলভাবে অক্সিজেন শোষণ করতে সমর্থ হয়েছে। এটা আমাদের জন্য খুশির খবর হলেও পানিতে শ্বাস নেওয়ার কি হলো? আমরা কি কোনদিন পানিতে শ্বাস নিতে পারবো না তাহলে?

মানুষও পারবে মাছের মতো পানিতে শ্বাস নিতে

মাছেরা যেমন ফুলকার সাহায্যে শ্বাস নেয় তেমন একটা ফুলকা যদি মানুষের জন্য তৈরী করা যেতো তাহলে কী হতো? মানুষও কি তখন মাছের মতো পানিতে শ্বাস নিতে পারতো? এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার পরে Alon Bodner নামের ইজরাইলের একজন বিজ্ঞানী মানুষের জন্যও মাছের মতো কৃত্রিম ফুলকা সৃষ্টি করেছেন। এই ফুলকার সাহায্যে পানিতে মাছের মতো শ্বাস নেওয়া যায়। এ কারনে যন্ত্রটির নামকরণও করা হয়েছে Like A Fish। এখন সমস্যা হলো মাছের শ্বসনে সামান্য অক্সিজেন লাগলেও মানুষের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক পরিমান অক্সিজেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, যন্ত্রটি কি পারবে মানুষের প্রয়োজনীয় এতো পরিমাণ অক্সিজেন এর যোগান দিতে?
মজার ব্যাপার হলো যন্ত্রটির কার্যক্ষমতা এতোটাই ব্যাপক যে, এটা প্রতি মিনিটে প্রায় ১৯০ লিটার পানিকে বিশ্লেষণ করতে পারে যা একজন মানুষের স্বাভাবিক শ্বাসকার্য বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট। তবে যন্ত্রটি আবিষ্কার হলেও সাধারন মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারছে না। প্রাথমিকভাবে শুধু মিলিটারিদের ব্যবহারের জন্য এর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে হয়তো নৌ-বাহিনীতে ব্যাপক হারে এই যন্ত্র ব্যবহার করা হবে। কারন যন্ত্রটি সহজে বহনযোগ্য এবং এর ব্যবহারে অতিরিক্ত কোন অক্সিজেন ট্যাংক এর প্রয়োজন হয়না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন