Ads (728x90)

একবিংশ শতাব্দীর এই কসমেটিক সার্জারীর যুগে মানুষের শরীরে কোনো প্রকার আপাত শারীরিক ত্রুটিও আর যেন ত্রুটি হিসেবে থাকছে না। এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ যেখানে প্রতিনিয়তই শারীরিক খুঁত আর নিখুঁতের মানদন্ডে মানুষকে বিচার করা হয়। এই আপাত ত্রুটি নিরাময়ে অনেক সময় আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত নিয়মের উল্টোটা গ্রহণ করে বসি। ভূলে যাই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট অনিন্দ সুন্দর শারীরিক নকশার কথা। কৃত্রিমতাকে আকড়ে ধরে খুঁত আর নিখুঁতের জগতে নিজের অবস্থানকে কিছুটা পাঁকাপোক্ত করায় মগ্ন হয়ে পড়ি আমরা। আর বিপত্তিটা ঘটে ঠিক তখনই। কসমেটিক সার্জারি হল সেই কৃত্রিমতারই নামান্তর।
সম্প্রতি জী ইয়ো নামের ২৯ বছর বয়সী যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক এক ফটোসাংবাদিক তার ক্যামেরায় কসমেটিক সার্জারির পরপরই কিছু দক্ষিণ কোরীয় নারীর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুলত তিনি কসমেটিক সার্জারির বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই এটা করেছেন বলে জানা যায়।
সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কসমেটিক সার্জারি করে থাকেন দক্ষিণ কোরীয়রা। এক্ষেত্রে সে দেশের নারীরাই পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে। গবেষণায় উঠে এসেছে এশীয় নারীরা বিশেষ করে দক্ষিণ কোরীয় নারীরা পাশ্চাত্যের নারীদের অনুসরণ করে তাদের মত শারীরিক গঠনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। ফলে তাদের দ্বারস্থ হতে হয় প্লাস্টিক বা কসমেটিকস সার্জারির। আর সারা বিশ্বে এই দক্ষিণ কোরীয় নারীরাই এর নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
ফটোসাংবাদিক জী ইয়ো তার এই ফটো সিরিজের নাম দেন ‘বিউটি রিকোভারি রুম’। এই সিরিজের জন্য তিনি কসমেটিক সার্জারি ফোরামের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সম্প্রতি কসমেটিক সার্জারি করেছেন এমন কিছু নারীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ছবি তোলেন।
পুরুষশাসিত এই সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারীকে বিচার করা হয় তার শারীরিক সৌন্দর্য্যের নিরিখে। ফলে একজন নারী জন্মলগ্ন থেকেই নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে কল্পনা করার চেয়ে একজন নারী হিসেবে কল্পনা করেন। সৌন্দর্য্য নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকেন। এই সুযোগটা গ্রহন করে বিভিন্ন কসমেটিক সার্জারি প্রতিষ্ঠান এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ‘আপনার ছোট স্তনকে বড় করুন’, ‘আপনার বড় স্তনকে ছোট করুন’, ‘আপনার ঠোটকে আকষর্নীয় করুন’, ‘আপনার নিতম্বকে সঠিক গঠন দান করুন’ ইত্যাদি বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সব বয়সী নারীদের সহজেই কাবু করতে সক্ষম হন এরা।

এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমেরিকান এক গবেষক জানান, কসমেটিক সার্জারির আপাত সফলতা রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব অনেক। একজন যদি একবার এই সার্জারি করেন। আর পরপরই যদি নেতিবাচক লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে এবং তিনি যদি আর্থিকভাবে পরবর্তিতে আরেকটি সার্জারির মাধ্যমে তা নিরাময় করার জন্য সচ্ছল না হন তাহলে সেই সমস্যাটা তার জন্য আরও ব্যাপক আকারে দেখা দেবে।
গবেষনায় দেখা গেছে, একবার যদি কোনো নারী তার স্তন, উঁরু, নিতম্ব, পেট বা শরীরের অন্য কোনো অংশে কসমেটিক সার্জারির মাধ্যমে চর্বি কমিয়ে ফেলেন। তাহলে শরীরের সেই স্থানে ভবিষ্যতে চর্বি তৈরি হতে নানবিধ সমস্যা দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রয়োজনের তুলনায় সঠিক পরিমাণের চর্বি তৈরি হচ্ছে না। যা শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিজ্ঞানীরা তাদের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বলেছেন, যারা স্তন বড় বা ছোট করার জন্য কসমেটিক সার্জারি করেন তারা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিকে আরও বহুগুনে বাড়িয়ে দেন। তাদের মতে, স্তনে কসমেটিক সার্জারি করেছেন এমন ৩৮% নারীই পরবর্তিতে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ২৬% নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র আমেরিকাতে প্রতিবছর পাঁচ লাখ মানুষ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন যাদের একটা বড় অংশই পূর্বে ত্বকে কোনো না কোনো জায়গায় কসমেটিক সার্জারি করেছিলেন। এছাড়াও কসমেটিক সার্জারির সাথে মনঃস্তাত্বিক ব্যাপার জড়িত। অনেকের ক্ষেত্রেই এটা সার্জারি পরবর্তি সময়ে ঘটে থাকে। কারণ জন্মলগ্ন থেকে যেই শারীরিক গঠনের সাথে মানুষের পথ চলা তাকে ছাড়ে নতুন রূপ গ্রহণ, তা যতই সুন্দর মনে হোক, সত্যি অনেক কঠিন একটি ব্যাপার।
তবে কসমেটিক সার্জারির প্রয়োজনীয়তা একেবারে যে নেই তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন দূর্ঘটনাজনিত কারণে বিকৃত হয়ে যাওয়া অঙ্গকে সুন্দর অবস্থায় নিয়ে যেতে এর দরকার রয়েছে। কিন্তু সুস্থ শরীরে শুধুমাত্র ঠুনকো সৌন্দর্য্যের আশায় কসমেটিক সার্জারীর আশ্রয় নেওয়াটা কত টুকু যৌক্তিক হবে তা বিবেচনার দায়িত্ব সম্পূর্ণটাই আপনার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন